চুয়াড় বিদ্রোহ ও কোল বিদ্রোহ | Chuar Mutiny and Kol Mutiny in Bengali
■ বাংলাদেশে বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম ও মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের জঙ্গলমহল নামে বনাঞ্চলের আদিবাসী কৃষকরা এই বিদ্রোহ করেছিল। এরা বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ও ধলভূমের পূর্বতন জমিদারদের পাইক বা সৈনিকের কাজ করে বেতনের বদলে ‘পাইকান জমি’ নামে পরিচিত নিষ্কর জমি ভোগ করত। নতুন জমিদারশ্রেণি এদের ঘৃণাভরে ‘চুয়াড়’ নামে অভিহিত করে।
সেই সঙ্গে কোম্পানির শাসন এদের জঙ্গল ও মাটির উপর অধিকারও কেড়ে নেয়। তা ফিরে পেতে এবং কোম্পানি -সৃষ্ট নতুন জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের প্রতিকারার্থে তারা এই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল (১৭৯৮ খ্রিঃ)। লাঠি-সড়কি, তির-ধনুক ছিল তাদের অস্ত্র। রায়পুর পরগণার পুরাতন জমিদার দুর্জন সিং ছিলেন তাদের নেতা। তাঁর নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহীরা সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ শাসনকে অচল করে দিয়েছিল।
এমনকি মেদিনীপুরের শালবনী অঞ্চলে তারা ইংরেজ সৈন্যকে পরাজিতও করেছিল। শেষ পর্যন্ত ইংরেজের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। বহু বিদ্রোহীকে গাছের ডালে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। তবে চুয়াড় বীরদের এই আত্মবলিদান ন্যায্য অধিকার অর্জনের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করার জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
■ কোল বিদ্রোহ:- ‘কোল’ ভারতের একটি আদিম উপজাতি। বিহারের ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ ‘কোলহান’ অঞ্চলে এরা স্বাধীনভাবে বসবাস করত। হো, মুণ্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ে এরা বিভক্ত। এরা ছিল যেমন সরল ও বন্য, তেমনি স্বাধীনতা-প্রিয়। এদের আদিম যৌথ সমাজ-জীবনে যখনই হস্তক্ষেপ হয়েছে, তখনই এরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে পোড়হাটের রাজা ব্রিটিশ আনুগত্য স্বীকার করে করদ রাজায় পরিণত হন।
তাই বিপুল করের দাবি মেটাতে পার্শ্ববর্তী হো-কোল অঞ্চলটিকে নিজের রাজ্যাংশ বলে দাবি করে রাজা জোর করে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে আদিবাসীরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে খাজনা আদায়কারী বেশ কিছু রাজকর্মচারী নিহত হয়। রাজা তখন কোম্পানির সাহায্য প্রার্থনা করলে (১৮২১ খ্রিঃ) এক বিশাল ইংরেজ বাহিনী কোলদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে, কিন্তু তাদের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তারা আবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
হিন্দু, মুসলমান ও শিখ মহাজনরা নতুন করে জমির ইজারা নিয়ে উচ্চহারে খাজনা আদায় করছিল; অনাদায়ে আদিবাসীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুঠপাট, স্ত্রীলোকের সম্মানহানি, জমি কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি ছিল অত্যাচারী মহাজনদের রীতি। এবারের কোল বিদ্রোহের সেটাই কারণ। সরাসরি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেনি। ইংরেজ প্রশ্রয়ে যারা উপজাতিদের জমি দখল করেছিল তারাই ছিল এদের আক্রমণের লক্ষ্য। এবারে রাঁচি জেলার মুণ্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায় সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারপর বিদ্রোহ মানভূম, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।