ওয়াহাবি আন্দোলনের বর্ণনা | Description of Wahhabi Movement
■ উনিশ শতকে বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি অভ্যুত্থান। ওয়াহাবি শব্দের অর্থ ‘নবজাগরণ’। হজরত মহম্মদের খাঁটি ইসলামি আদর্শ সামনে রেখে আরবদেশে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৮৭ খ্রিঃ) ইসলাম ধর্মসংস্কারের উদ্দেশে ‘তারিখ-ই-মহম্মদীয়া’ নামে আন্দোলন শুরু করেন। ভারতে তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। দিল্লির প্রখ্যাত ধর্মজ্ঞানী শাহ ওয়ালিউল্লা (১৭০২-৬২ খ্রিঃ) ভারতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তারই প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাইবেরিলিতে সৈয়দ আহম্মদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রিঃ) সারা ভারত ওয়াহাবি আন্দোলনের ডাক দেন।
বাংলাদেশের বারাসতে তিতুমীরের আন্দোলন ছিল তারই একটি বর্ধিত রূপ। ওয়াহাবি আন্দোলন প্রথমে ধর্মীয় কারণকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও অল্পকালের মধ্যেই বাংলা, বিহার, মীরাট, হায়দ্রাবাদ, এমনকি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। ধীরে-ধীরে কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ এই আন্দোলনে যোগদান করায়, বিশেষ করে বাংলায়, এটি একটি কৃষক অভ্যুত্থানেও পরিণত হয়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বারাসতে তিতুমীর -এর নেতৃত্বে এই কৃষক-বিদ্রোহ সর্বপ্রথম তার সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে।
সমসাময়িক সরকারি কাগজপত্র, পুলিশ রিপোর্ট ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টারের দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্ গ্রন্থ থেকে এই তথ্য আমরা পাই। হান্টার লিখেছেন, কেবল মুসলমানেরাই নয়, নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাও এই আন্দোলনে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিক ডব্লু.সি.স্মিথও বলেছেন, বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন তার ধর্মীয় চরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠে একটি কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে মীর নিশার আলি ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন।
বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুয়ানি থেকে মুক্ত করাই ছিল তিতুর প্রাথমিক লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যেই তিনি মক্কায় তীর্থযাত্রা করেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে সৈয়দ আহম্মদের পরিচয় হলে তিনি ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত হন। মক্কা থেকে ফিরে তিতু মুসলমান উলেমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলমানদের পক্ষে এক ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে বাঁচার তাগিদে উচ্চ শ্রেণির মুসলমানরাও তিতুর বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের সঙ্গে হাত মেলায়। কারণ তিতুর এই আন্দোলনের মধ্যে এক সামগ্রিক কৃষক আন্দোলনের ভয়াবহ পূর্বাভাস তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন।
নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাই বারাসতে সংঘর্ষের ফলে যে অল্প-বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয় তার জন্য জমিদাররা ওয়াহাবিদের কাছ থেকে অর্থদণ্ড আদায় করতে থাকেন। ফলে ওয়াহাবিদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পুঁড়ার প্রতাপান্বিত জমিদার কৃথ্বদের রায় পাইক-বরকন্দাজ সহ সরফরাজপুর গ্রামে মুসলমান অধিবাসীদের কাছ থেকে জোর করে অর্থদণ্ড আদায় করতে গেলে এক প্রচণ্ড বিক্ষোভের সম্মুখীন হন।
এইভাবে শুরু হয় এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম যার একদিকে ছিলেন স্থানীয় সরকারি আমলা, নীলকর সাহেব ও হিন্দু-মুসলিম জমিদাররা; আর অন্যদিকে স্বয়ং তিতুমীর। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে তিতু প্রচুর খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখেন। এ ব্যাপারে তিনি ফকির মিশকিন শাহ-এর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য লাভ করেন। এইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে মাত্র ৩০০ অনুচর সহ একদিন তিতু গুঁড়ার প্রতাপান্বিত জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করেন। ওই দাঙ্গায় একদিকে যেমন হিন্দুদের মন্দির বিধ্বস্ত ও পুরোহিত নিহত হন, অন্যদিকে তেমনি বেশ কিছু ধনী মুসলমান গৃহও লুণ্ঠিত হয়। এর অল্পকাল পরেই তিতু কোম্পানি-শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং নিজেকে নবাবের প্রতিনিধি ঘোষণা করে বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিদার ও নীলকরদের কাছ থেকে রাজস্ব দাবি করেন।
পরিণতি হিসাবে নীলকর দানিকেন, জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখার্জী ও দেবনাথ রায়ের নেতৃত্বে নীলকর ও জমিদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে তিতুর বাহিনীকে সরাসরিভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয়। এই ঘটনা বারাসত বিদ্রোহ নামে বহুল পরিচিত। যশোহরের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার এক বিরাট বাহিনী নিয়ে বাদুড়িয়ায় তিতুর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। কিন্তু তিতুর ভাগিনেয় গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে ওয়াহাবিরা সরকারি বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে। এই জয়লাভ এক ব্যাপক এলাকায় ওয়াহাবি আন্দোলনকে বিস্তৃত করতে সাহায্য করে। এই সময় তিতু তাঁর সৈন্যবাহিনীকে সংগঠিত করেন এবং সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য মনোনিবেশ করেন। তিনি মৈনুদ্দিন নামে একজন ওয়াহাবিকে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং বাদুড়িয়ার কাছে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। এদিকে সাতক্ষিরা, গোবরডাঙা ও নদিয়ার জমিদার ও নীলকররা কোম্পানির সৈন্যদের সঙ্গে একযোগে তিতুর আন্দোলনকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর হন।
এই সম্মিলিত বাহিনীও কিন্তু গোলাম মাসুমের কাছে পরাজিত হয়। এর ফলে মনোহর রায় নামে এক হিন্দু জমিদার-সহ বহু সম্ভ্রান্ত হিন্দু তিতুর পক্ষে যোগদান করেন। এবার গভর্নর-জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুর অগ্রগতিকে স্তব্ধ করার জন্য একজন কর্নেলের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান। কামানের গোলায় বাঁশের কেল্লা বিধ্বস্ত হয়। তিতু নিহত হন (১৯ শে নভেম্বর, ১৮৩১)। কয়েকজন অনুচরসহ বন্দি গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্যান্যদের কারারুদ্ধ কিংবা দ্বীপান্তরিত করা হয়। এইভাবে বাংলার এক অন্যতম কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।
বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল সত্য, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এই অসাধারণ বিদ্রোহ ভারতে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ইংরেজের গোলার আঘাতে নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা কুটোর মতো উড়ে গেলেও তিতুকে ঘিরে দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের আত্মত্যাগের কাহিনি কিন্তু বাংলার জনমনে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অক্ষয় দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল।