শিল্প স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ Favorable environment for setting up industries

শিল্প স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ (Favorable environment for setting up industries) :

কোনাে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে শ্রমশিল্পের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমশিয়ে অবস্থানের কারণ নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। যথা –

(i) শিল্পের সর্বনিম্ন উৎপাদন ব্যয়

(ii)ক্রেতার সর্বনিম্ন ক্রয়মূল্য

এ প্রসঙ্গে জার্মান অর্থনীতিবিদ অ্যালফ্রেড ওয়েবার যে তথ্য দিয়েছেন তার সাহায্যে শিল্পের একদেশীভবনের প্রকৃত কারণ জানা যায়। বিশ্বের যে – কোনাে স্থানে শিল্প স্থাপন করতে হলে মূলত দু – ধরনের অনুকূল পরিবেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। যথা –

(ক) অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ

(খ) অনুকূল অপ্রাকৃতিক পরিবেশ

( ক )শিল্প স্থাপনের অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural favorable natural environment for setting up industries) : যেসব অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে কোনাে স্থানে শিল্পের বিকাশ ঘটে সেগুলি হল-

(1) কাঁচামালঃ শিল্প স্থাপনে কাঁচামালের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যন্ত্রের সাহায্যে কাঁচামালকে রূপান্তর করে। ব্যবহারের উপযােগী করে তােলাই শিল্পের কাজ। বিভিন্ন কৃষিজ, বনজ, খনিজ এবং প্রাণীজ দ্রব্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাঁচামাল দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা – (i) বিশুদ্ধ কাঁচামাল এবং (ii) অবিশুদ্ধ বা ওজন হ্রাসপ্রাপ্ত কাঁচামাল। সাধারণভাবে কাঁচামাল প্রাপ্তিযুক্ত অঞ্চলের কাছেই শিল্পকেন্দ্র গড়ে তােলা সুবিধাজনক। এর ফলে পরিবহণ ব্যয় কম। হয় বলে শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন ব্যয় কম পড়ে।

(2) শক্তিসম্পদঃ আধুনিক শিল্প ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে জড়শক্তি – নির্ভর বলে যে – কোনাে শিল্প স্থাপনে শক্তির জোগান অপরিহার্য। সাধারণভাবে কয়লা বা স্বাভাবিক গ্যাস থেকে উৎপন্ন তাপবিদ্যুৎ, বেগবতী জলধারা থেকে উৎপন্ন। জলবিদ্যুৎ এবং আণবিক পদার্থ থেকে উৎপন্ন আণবিক বিদ্যুৎ শিল্পকর্মে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু শক্তি সম্পদ বহুদূরে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই ব্যয়সাপেক্ষ, সেহেতু শক্তি সম্পদের কাছাকাছি শিল্পকেন্দ্র গড়ে তােলা সুবিধাজনক। বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ জাপানের শিল্পোন্নতির অন্যতম কারণ সেদেশের অফুরন্ত জলবিদ্যুৎ শক্তির জোগান।

(3) অনুকূল জলবায়ুঃ শিল্পোন্নতিতে জলবায়ু প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, আর্দ্র সামুদ্রিক জলবায়ুতে সুতাে ভালাে পাক খায় বলে এরূপ জলবায়ুতে কার্পাস বয়ন শিল্প স্থাপন খুবই সুবিধাজনক হয়। জলবায়ুর পরােক্ষ প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে – নাতিশীতােষ্ণ বা সমভাবাপন্ন জলবায়ুতে শ্রমিকের কর্মকুশলতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই কারণে পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলি বা জাপানের শ্রমিকেরা অনেক বেশি কর্মকুশল। আবার, জলবায়ুর ওপর শিল্পের চাহিদাও নির্ভর করে। যেমন – শীতপ্রধান দেশে পশম বস্ত্রের চাহিদা বেশি।

(4) জলের জোগানঃ শিল্প স্থাপনে জলের জোগান অপরিহার্য। পাট শিল্প, কার্পাস বয়ন শিল্প, কাগজ শিল্প, লােহা ও ইস্পাত শিল্প, রাসায়নিক শিল্প প্রভৃতি শিল্পে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়ােজন হয় বলে এইসব শিল্প নদী বা হ্রদের তীরে গড়ে তােলা হয়।

( খ ) শিল্প স্থাপনের অনুকূল অপ্রাকৃতিক পরিবেশসমূহ (Unatural favorable environments for setting up industries) : শিল্প স্থাপনে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি বেশ কিছু অপ্রাকৃতিক পরিবেশও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –

(1) উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থাঃ শিল্পকেন্দ্রে কৃষিজ, খনিজ, বনজ প্রভৃতি কাঁচামাল আমদানি; শ্রমিকদের যাতায়াত এবং উৎপন্ন শিল্পদ্রব্য বাজারে বা বন্দরে পাঠানাের জন্য উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার প্রয়ােজন হয়।

(2) চাহিদা বা বাজারঃ ভােগের জন্যই শিল্পজাত দ্রব্যাদি উৎপাদিত হয়। সুতরাং, যে – কোনাে শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয় চাহিদা বা বাজারের ওপর নির্ভর করে। এই কারণে ঘনবসতিযুক্ত অঞ্চলে অথবা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী অস্কুলে শিল্পস্থাপন অনেক বেশি সুবিধাজনক। আবার দ্রুত পচনশীল দ্রব্যজাত শিল্পগুলি বাজারের কাছেই ঘুরে ওঠে যেমন – দুধ শিল্প।

(3) মূলধনের জোগানঃ শিল্প স্থাপনে মূলধনের জোগান একান্ত অপরিহার্য। কারণ, শিল্পকেন্দ্রের জমি ক্রয়, কারখানা স্থাপন, যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপন, কাঁচামাল ক্রয়, শক্তির জোগান প্রভৃতি কাজে প্রাথমিকভাবে প্রচুর মূলধনের প্রয়ােজন হয়। এই কারণে সমৃদ্ধিশালী দেশগুলি শিল্পকর্মে প্রচুর মূলধন বিনিয়ােগ করতে পারে বলে ওইসব দেশে শিল্পস্থাপন ও শিল্পোন্নতি বিশেষ অনুকূল হয়।

(4) সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকঃ প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদগণের মতে, “সুলভ শ্রমিকই শিল্প গঠনের অন্যতম হাতিয়ার।” কারণ শ্রমিকের নিপুণতা ও কর্মকুশলতা শিল্পোন্নতির অন্যতম সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাপান ও চিনের শিল্পোন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ হল – এই দুটি দেশের বিপুল পরিমাণ সুলভ শ্রমিক। আবার, প্রচুর কাঁচামাল থাকলেও সুলভ শ্রমিকের অভাবে অস্ট্রেলিয়ায় শিল্পের আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি।

(5) আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়ােগঃ উন্নত প্রযুক্তির প্রয়ােগ বা কারিগরি দক্ষতা আধুনিককালে শিল্পোন্নতির অন্যতম শর্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, জাপান, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণেই আজ শিল্পক্ষেত্রে উন্নতির চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছে।

(6) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাঃ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল অঞ্চলে শিল্পোন্নতি সহজতর হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ রাজ্যে বহু দেশি ও বিদেশি শিল্পপতিদের পুঁজি বিনিয়ােগে আকৃষ্ট করেছে।

(7) সরকারি নীতিঃ অনুকূল সরকারি নীতি শিল্পোন্নতির পক্ষে খুবই সহায়ক। যেমন- সহজ লাইসেন্স নীতি, আমদানি রপ্তানির শুল্ক হ্রাস, নতুন শিল্পনগরী স্থাপন প্রভৃতি বিষয়গুলি শিল্পস্থাপন ও শিল্পোন্নয়নের পক্ষে খুবই সহায়ক।

Leave a comment