মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস | Great History of Maurya Empire, Rulers, Fall of Empire

History of Maurya Empire :The founder of the Maurya dynasty was Chandragupta Maurya (324-300 BC). Under his leadership, with the beginning of a glorious and groundbreaking chapter in the political history of India, the ideal of establishing an all-India empire took shape. In fact, Chandragupta Maurya appeared in the arena of history at a critical and depressing moment in the history of India. On the eve of his arrival, north-west India was under the control of foreign Greek power and on the other hand, East India was plagued by anti-people Nanda misrule.

মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস, শাসকবৃন্দ, পতনের কারণ(History of Maurya Empire, Rulers, Fall of Empire):

[ক] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-

মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-৩০০ খ্রিস্ট পূর্ব)। তার নেতৃত্বে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবময় ও যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ বাস্তব রূপ গ্রহণ করে। বস্তুত ভারত – ইতিহাসের এক জটিল ও হতাশাব্যঞ্জক মুহূর্তে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ইতিহাসের আঙ্গিনায় আবির্ভূত হন। তাঁর আগমনের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারত ছিল বিদেশি গ্রীক শক্তির কবলে এবং অন্যদিকে পূর্ব ভারত ছিল জনবিরােধী নন্দ কুশাসনে জর্জরিত।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

[ ১ ] আদি পরিচয় : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আদি পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। পুরাণ ও মুদ্রারাক্ষস নাটকে তাকে শূদ্রবংশের সন্তান বলে অভিহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বৌদ্ধ ও জৈন সূত্র অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত ‘মােরিয়’ ক্ষত্রিয় বংশজাত। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অনেক বিচার বিবেচনা করে চন্দ্রগুপ্তকে ক্ষত্রিয় বংশজাত বলেই সিদ্ধান্তে এসেছেন। চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে নন্দবংশের সম্রাট ধননন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। কিংবদন্তী থেকে জানা যায়। যে, চন্দ্রগুপ্তের পিতা ধননন্দের হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেই হত্যার প্রতিশােধ নেবার জন্য চন্দ্রগুপ্ত চাণক্য নামে এক ব্রাত্মাণের সাহায্য নেন। সম্মুখ যুদ্ধে নন্দসেনাপতি ভদ্রশাল পরাজিত হন।

[ ২ ] গ্রীক আক্রমণ প্রতিহতকরণ : মগধের সিংহাসন দখল করার পর চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক আক্রমণের সম্মুখীন হন। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সুবিশাল সাম্রাজ্য বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিরিয়া ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল সেলুকাস নামে এক গ্রীক সেনাপতির কর্তৃত্বে আসে। পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ চন্দ্রগুপ্তের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সেলুকাস এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান শুরু করেন (৩০৫ খ্রিঃপূর্ব)। চন্দ্রগুপ্ত তাকে বাধা দেন। এবং শেষ পর্যন্ত সেলুকাস পরাজিত হন। অবশেষে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সন্ধি করেন, এই সন্ধির শর্ত অনুসারে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে হিরাট, কাবুল, কান্দাহার ও মাকরাণ এই চারটি প্রদেশ ছেড়ে দেন এবং সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় মেগাস্থিনিস নামে এক গ্রীক দূতকে পাঠান। মেগাস্থিনিসের ভারত সম্পর্কে লিখিত বিবরণ ইন্ডিকা’ নামে পরিচিত।

[ ৩ ] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্ষের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড তিনটি উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল , যেমন : প্রথমত, তিনি নন্দবংশের উচ্ছেদ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পশ্চিম ভারতে বিদেশি গ্রীক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, এরপর তিনি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন।

[ 4 ] সাম্রাজ্য বিস্তার : চন্দ্রগুপ্ত মগধের সাম্রাজ্যসীমা ভারতের প্রায় সর্বত্র প্রসারিত করেন। গিরণর শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, গুজরাট, অবন্তী, মালব, মহারাষ্ট্র ও কোঙ্কন অঞল তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। দক্ষিণে গােদাবরী নদী অতিক্রম করে তিনি মহীশূর ও মাদ্রাজের তিনেভেলী পর্যন্ত অগ্রসর হন। ঐতিহাসিক ডঃ রাধাকুমুদ মুখ্যোপাধ্যায় চন্দ্রগুপ্তকে “প্রথম ঐতিহাসিক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা” বলে অভিহিত করেছেন




[ 5 ] শাসক হিসেবে মূল্যায়ন : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধুমাত্র দিগ্বিজয়ী বীর ছিলেন না, দক্ষ শাসক হিসাবেও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি যেমন রাজচক্রবর্তীর আদর্শকে বাস্তবায়িত করেছিলেন, অন্যদিকে একটি সুনিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশাল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত কীভাবে এক সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। মৌর্য শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সম্রাট। স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও চন্দ্রগুপ্ত জনকল্যাণের লক্ষ্য থেকে সরে আসেন নি। মেগাস্থিনিসের বিবরণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে রাজধানী পাটলিপুত্রের শাসন কাঠামাে, রাজস্ব ব্যবস্থা, বিভাগ প্রভৃতি সম্পর্কে নানান তথ্য জানা যায়।

চাণক্য তক্ষশীলার ব্রাহ্মণ আচার্য্য এবং বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবাদানুসারে, মগধ শাসনকারী নন্দ রাজবংশের সম্রাট ধননন্দ দ্বারা অপমানিত হয়ে চাণক্য নন্দ সাম্রাজ্য ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করেন। চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তার সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন।বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে চাণক্যের কূটনৈতিক বুদ্ধির সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনা বর্ণিত রয়েছে।

৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য তার সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ম্যাসিডনীয় সত্রপ রাজ্যগুলির দিকে নজর দেন। তিনি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদ উপত্যকা অঞ্চলের শাসক ইউদেমোস ও পাইথনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন বলে মনে করা হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষের সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর তাকে আরাকোশিয়া, গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল অঞ্চল সমর্পণ করতে এবং নিজ কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দিতে বাধ্য হন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পর প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরকে ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সহায়তা করেন। যা ইপসাসের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে জয়লাভে সহায়তা করে।

এরপর চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ দখল করতে সক্ষম হন। এর ফলে কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের অল্পকিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার মৌর্য্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

[ খ ] বিন্দুসার (খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০-২৭৩ অব্দ)

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র বিন্দুসার ‘অমিত্রাঘাত’ (শনিধনকারী) উপাধি গ্রহণ করে মগধের সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজত্বকালে পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিম দিকে আরবসাগরের মধ্যবর্তী অংশের বিস্তৃত অঞ্চল মগধের দখলে আসে। বিন্দুসার গ্রীকদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখেছিলেন। তিনি শান্তিকামী, সৌখীন ও শিক্ষার অনুরাগী ছিলেন। ২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের স্বেচ্ছা অবসরের পর তার পুত্র বিন্দুসার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। বিন্দুসার মৌর্য্য সাম্রাজ্যকে তিনি দক্ষিণ দিকে আরো প্রসারিত করেন।

বিন্দুসার
বিন্দুসার

 কলিঙ্গ, চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজ্য ব্যতিরেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ছাড়াও উত্তর ভারতের সমগ্র অংশ তার করায়ত্ত হয়। তার রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করেন কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি।




[ গ ] অশােক ( খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দ )

বিন্দুসারের পর তার সুযােগ্যপুত্র অশােক খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ সালে মগধের সিংহাসনে বসেন। অশােকের মতাে প্রতিভাসম্পন্ন সম্রাট শুধু ভারতের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। তার সাফল্যের স্বীকৃতি মেলে ডঃ হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর এই মন্তব্যে, “অশােকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উদ্যম, সমুদ্রগুপ্তের বিবিধমুখী প্রতিভা এবং আকবরের ঔদার্য। রাজ্যজয় সিংহাসনে আরােহণ করে অশােক পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত রাজ্য বিস্তার নীতি অনুসরণ করেন। প্রবল যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি কলিঙ্গ রাজ্যকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের হত্যালীলা তাকে ব্যথিত করে। তিনি এর পর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন এবং রাজ্য জয়ের পরিবর্তে ধর্ম বিজয় নীতি গ্রহণ করেন। এইভাবে কলিগযুদ্ধের পর মৌর্য সাম্রাজ্য একটি ঐক্যবদ্ধ শান্তিবাদী অহিংস রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

অশােক
অশােক

২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিন্দুসার তার অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসেবে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা তার অপর পুত্র অশোককে সমর্থন করেন। রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অশোক শঠতা করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। দীপবংশ ও মহাবংশ গ্রন্থানুসারে, বীতাশোক নামক একজন ভাইকে ছেড়ে অশোক বাকি নিরানব্বইজন ভাইকে হত্যা করেন, কিন্ত এখনো পর্যন্ত এই ঘটনার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতার মৃত্যুর তিন বছর পরে তিনি মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

[১] সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তার সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরুকরে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তার করায়ত্ত হয। তার রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হন। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন, এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদী সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। তার পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।

History of Maurya Empire
History of Maurya Empire

[ ২ ] শাসন ব্যবস্থা : অশােকের শাসন ব্যবস্থায় এককেন্দ্রীয় নীতির প্রভাব থাকলেও তা পিতৃত্ববােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক সংহতি স্থাপন ছিল তার শাসন ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনকল্যাণকে তিনি শাসন নীতির ভিত্তিতে পরিণত করেন। কল্যাণমুখী প্রশাসন পরিচালনার জন্য অশােক রাজুক, প্রাদেশিক, ধর্মমহামাত্র প্রমুখ নতুন শ্রেণির কর্মচারী। নিয়ােগ করেন। সব মানুষ আমার সন্তান তুল্য (সব মুনিষে প্রজামমা) এই ছিল তার ধারণা। বস্তুত ভারতের ইতিহাসে অশােকই প্রথম। সম্রাট যিনি প্রজা কল্যাণকর। রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

[ ৩ ] ধর্মনীতি : ব্যক্তিগত জীবনে অশােক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি তার নিজের ধর্মমত প্রজাদের ওপর জোর করে আরােপ নি। তিনি শিলালিপিতে ‘ধম্ম’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। ডঃ রােমিলা থাপার ধর্মের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন। অশােক সামাজিক দায়িত্ববােধের মনােভাব নিয়ে ধর্মকে দেখেছিলেন। সে কারণে অশােকের অনুসৃত ধর্মকে কোনাে বিশেষ ধর্ম না বলে নৈতিক কর্তব্য পালনের নীতি বলাই যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে ভাণ্ডারকর, বড়ুয়া, হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী প্রমুখ ঐতিহাসিকদের অভিমত হল অশােক অর্থে বৌদ্ধধর্মে প্রকৃত দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং তাঁর অনুসৃত নীতিকে বৌদ্ধধর্মের প্রয়ােগ বলা চলে।

[ 4 ] বিশ্বজনীন ধর্ম : অশােক যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন তা বৌদ্ধধর্মের তুলনায় অনেক বেশি উদার ও মানবতাবাদী বলা যায় । তিনি পরিশুদ্ধ সামাজিক জীবন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে দান, দয়া, প্রভৃতি ১২ টি গুণের অনুশীলন করবার নির্দেশ দিয়েছেন। তার প্রচলিত ধর্মে নানা ধর্মের সার কথাগুলি স্থান পেয়েছিল। এই বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় ডঃ রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়ের মন্তব্যে, অশােক তাঁর ধর্মে ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অশােক সুদূর দক্ষিণের চোল, পাণ্ড্য, কেরলপুত্র, সত্যপুত্র এবং গ্রিস, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ধর্মদূত পাঠান। ঐতিহাসিক ওয়েলস ঠিকই বলেছেন যে, জাপান থেকে ভলগা পর্যন্ত স্থানে অশােক এখনও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

[ ৫ ] পরধর্মমত সহিষ্ণুতা : ব্যক্তিগতভাবে অশােক বৌদ্ধধর্মের উপাসক হলেও অন্যান্য ধর্মমতের প্রতিও তিনি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । এই প্রসঙ্গে অশােক ঘােষণা করেন , রাজা সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতিই সমান সম্মান প্রদর্শন করেন । তাঁর রাজত্বে ব্ৰায়ণ , শ্রমণ , জৈন , আজীবক সকলেই সমান সম্মানের অধিকারী ছিলেন । দ্বাদশ গিরিলেখ অনুশাসন থেকে তাঁর উদারতার পরিচয় পাওয়া যায় ।




Also Read:-

◾  350+ জীবনবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর pdf – Click Here

   WBCS Exam Syllabus in Bengali :- Click Here

   History MCQ for WBCS in Bengali:- Click Here

◾   250+ WBCS General Knowledge in Bengali:- Click Here

   WBCS পরীক্ষার বছর ভিত্তিক ভূগোল প্রশ্নোত্তর:- Click Here

   WBCS প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্ন ও উওর:- Click Here

◾   General knowledge for WBCS:- Click Here

◾   বিগত বছরের WBCS পরীক্ষার ইতিহাস প্রশ্নোত্তর:- Click Here

150+ জীবনবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর pdf – Click Here

◾   বাংলা ব্যকরণ প্রশ্ন ও উওর – Click Here

ভৌতবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ SAQ প্রশ্নোত্তর – Click Here

◾   ব্যাকরণ জিকে সমাধান – Click Here

◾   Bengali Grammer MCQ pdf – Click Here

[ ৬ ] বৈদেশিক নীতি : সম্রাট অশােক প্রতিবেশী ও অন্যান্য বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য শান্তি ও অহিংসার নীতি অনুসরণ করেন। সুদূর দক্ষিণের চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র এই চারটি রাজ্যের সঙ্গে তিনি মিত্রতা গড়ে তােলেন। এছাড়া তাঁর রাজত্বকালে সিংহল, ব্রহ্লাদেশ, নেপাল, তিব্বতের সঙ্গেও মৌর্য সাম্রাজ্যের মৈত্রীবন্ধন স্থাপিত হয়। ধর্মপ্রচার ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যে তিনি পশ্চিম এশিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলিতে দূত পাঠান।

[ ৭ ] জনহিতকর কার্যাবলী : বিভিন্ন সংস্কার সাধনের মাধ্যমে অশােক মৌর্য শাসনব্যবস্থাকে জনকল্যাণমুখী করে তােলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহু রাজপথ, অতিথিশালা, মানুষ ও পশু চিকিৎসালয় স্থাপন, বৃক্ষরােপণ, কূপ খনন ও নানাস্থানে ঔষধির চারা রােপণের ব্যবস্থা করেন। এমনকি তিনি পশুহত্যাও বন্ধ করেন। তিনি বলতেন, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণসাধন করার চেয়ে মহৎ কিছু নেই। অশােকের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীর অনিবার্য ফলস্বরূপ ব্যাবসা বাণিজ্যের উন্নতি ঘটে এবং সাম্রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হয়।

[ ৮ ] মূল্যায়ন : অশােক ছিলেন বিশ্বের প্রথম জ্ঞানদীপ্ত সম্রাট। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ অশােককে সর্বকালের এবং সর্ব দেশের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম বলে স্বীকার করেছেন। তাঁকে কনস্টানটাইন, আলেকজাণ্ডার, জুলিয়াস সিজার, শার্লেম্যান, আকবর, নেপােলিয়ন প্রমুখ বিশ্বের উল্লেখযােগ্য সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সম্রাট বলে অভিহিত করা হয়েছে। অশােকের অনন্য গুণাবলি স্মরণ করেই ঐতিহাসিক এইচ . জি . ওয়েলস যথার্থই বলেছেন যে, “ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় হাজার হাজার নরপতির মধ্যে অশােক একমাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র, ভল্লা থেকে জাপান পর্যন্ত তাঁর নামকে এখনও স্মরণ করা হয়।”

সমালােচনা : বিশ্ব ইতিহাসে অশােককে শ্রেষ্ঠতম নৃপতি বলে অভিহিত করা হলেও তার রাজত্বকাল একেবারে সমালােচনা মুক্ত ছিল না, কারণ : প্রথমত, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাকে ব্রাত্মণ বিদ্বেষী ও মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেছেন। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাণ্ডারকরের মতে, অশােকের অতি আধ্যাত্মিক নীতিই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে। অবশ্য ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডঃ হেমচন্দ্র চৌধুরী এইসব সমালােচনার বিরােধিতা করে অশােকের কৃতিত্বকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। আর সে কারণেই ঐতিহাসিক স্মিথস্পষ্টতই বলেছেন অশােক ছিলেন মানবজাতির প্রথম ধর্মগুরু।

[ ঘ ] মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস(History of the Maurya Empire):

প্রবাহমান ভারত – ইতিহাসে মৌর্য শাসনের গুরুত্ব সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। মৌর্য সম্রাটরাই সর্বপ্রথম উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য জয় করে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশিএকটি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিত এক – কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্ষের প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা এবং অশােকের সংযােজন এই দুইটি বিষয়কে ভিত্তি করেই মৌর্য শাসনের পরিকাঠামাে গড়ে ওঠে। মেগাস্থিনিসের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, প্রিনির বিবরণ, দিব্যবধান, মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ, জুনাগড় শিলালিপি এবং অশােকের শিলালিপি থেকে মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।

[ ১ ] কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা : মৌর্য শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক এই দুইটি স্তরে বিন্যস্ত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রধান ছিলেন রাজা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান শাসক, ধর্ম রক্ষক, প্রধান বিচারপতি ও আইন প্রণেতা। বংশানুক্রমিক মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজাদের সীমাহীন ক্ষমতা লক্ষ করে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মৌর্য শাসনকে “বল্গাহীন স্বৈরতন্ত্র” নামে অভিহিত করেছেন। তবে মৌর্য সম্রাটরা কখনও সীমাহীন স্বৈরাচারী ছিলেন না, তারা নিজেদের ‘দেবনাং প্রিয় বলে দাবি করতেন।

❏ মন্ত্রীপরিষদ : শাসনব্যবস্থার সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য সম্রাট নানা স্তরের রাজ কর্মচারীদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, এদের বলা হত অমাত্য বা সচিব। সচিবদের মধ্যে যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মন্ত্রী বা মন্ত্রিণ পদে নিয়ােগ করা হত। মন্ত্রীগণ প্রশাসন, পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। এঁদের বেতন ছিল বার্ষিক ৪৮ হাজার পান। অন্যদিকে সাধারণ মন্ত্রীদের বেতন ছিল বার্ষিক ১২ হাজার পান। কেন্দ্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য অমাত্য, অধ্যক্ষ প্রমুখ নানান বিভাগীয় কর্মচারী ছিলেন। এছাড়াও মৌর্য শাসনব্যবস্থায় দৈবারিক, প্রতিবেদক, পুরােহিত, গুপ্তচর প্রভৃতি রাজকর্মচারীদের সন্ধান পাওয়া যায়।

[ ২ ] প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা : সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠু পরিচালনার উদ্দেশ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যকে ৪ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়, এগুলি হল — প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণাপথ। এরপর অশােকের কলিঙ্গ বিজয়ের পর মৌর্য সাম্রাজ্যে কলিঙ্গ প্রদেশ সংযােজিত হয়। প্রদেশগুলির শাসনকর্তাদের প্রাদেশিক’বলা হত, সাধারণত এই পদে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ রাজপুরুষরাই নিযুক্ত হতেন। প্রদেশগুলি যথাক্রমে জেলাবা আহরও গ্রামেবিভক্ত ছিল। সমাহর্তা নামে এক শ্রেণির কর্মচারী জেলার দায়িত্বে ছিলেন আর ‘গ্রামিক’ ছিলেন গ্রামের শাসনকর্তা।

[ ৩ ] নগর প্রশাসন : মৌর্য যুগে শহরাঞ্চলগুলি প্রত্যক্ষভাবে শাসিত হত। মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুসারে ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের ওপর নগরীর শাসনভার ন্যস্ত ছিল। নগর পরিচালনার জন্য পাঁচ জন সদস্য নিয়ে দুটি পৃথক সমিতি গঠিত ছিল। এই সমিতিগুলির দায়িত্ব ছিল জন্মমৃত্যুর হিসাব সংরক্ষণ, ব্যাবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, শুল্ক সংগ্রহ, শিল্পকার্যের তত্ত্বাবধান প্রভৃতি। পাটলিপুত্র ছাড়া তক্ষশীলা, কলিঙ্গ, কোশাম্বী, উজ্জয়িনী ও সুবর্ণগিরি শহরে সম্ভবত একই ধাঁচের শাসনবিধি প্রচলিত ছিল।

[ ৪ ] সামরিক সংগঠন : মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিশাল সামরিক সংগঠনের পরিচয় মেলে। সেনাবাহিনীতে ছয় লক্ষ পদাতিক, ত্রিশ হাজার অশ্বারােহী, নয় হাজার হাতি, ও অগণিত রথ ছিল। ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি সামরিক পরিষদের হাতে সামরিক বিভাগের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। সামরিক বিভাগের পাশাপাশি মৌর্য সাম্রাজ্যের গুপ্তচরব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে সে যুগের অন্তত তিন রকমের গুপ্তচরের উল্লেখ পাওয়া যায়, এরা হল সমস্থা, সঞরা এবং পরিদর্শক। ঐতিহাসিক রােমিলা থাপারতার ‘History of India (Vol – 1) শীর্ষক গ্রন্থে মৌর্য সাম্রাজ্যের গুপ্তচর ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

[ ৫ ] বিচারব্যবস্থা : মৌর্য সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ এবং কঠোর। স্বয়ং সম্রাট ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারক। এছাড়া গ্রাম ও শহরের বিচারব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে গ্রামিক ও নগর ব্যবহারিক।

[ ৬ ] রাজস্বব্যবস্থা : কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায়ের উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্রই ছিল জমির মালিক। বলি’ও ‘ভাগ’ – এই দু’রকমের খাজনা আদায় করা হত। ভূমিরাজস্বের পরিমাণ ছিল এক ষষ্ঠাংশ অথবা এক চতুর্থাংশ। এছাড়াও সে যুগে বাণিজ্য শুল্ক, জন্ম ও মৃত্যু কর, জল কর, পথ কর প্রভৃতি থেকেও রাজস্ব আদায় হত।

[ ৭ ] অশােকের সংযােজন : কলিঙ্গযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সম্রাট অশােক মৌর্য শাসনব্যবস্থায় কিছু সংস্কার প্রবর্তন করে তাকে জনকল্যাণমুখী চরিত্র দান করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি যুত, রাজুক, মহাপাত্র, প্রাদেশিক, নগর ব্যবহারিক, প্রতিবেদক নামক কর্মচারী নিয়ােগ করেছিলেন। তাঁর আমলে প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের উদ্দেশ্যে নানা রকমের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

[ ৮ ] মূল্যায়ন : মৌর্যযুগেই ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গঠন ও শাসন কাঠামাে প্রবর্তনের ঐতিহ্য গড়ে উঠলেও তা একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না, কারণ : ( ১ ) আমলাতন্ত্রের প্রভাব বেশি থাকায় প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের সুযােগ ছিল না। তাছাড়া ভৌগােলিক দিক থেকে বিশালাকার সাম্রাজ্যের সুষ্ঠুশাসন পরিচালনা সহজ ব্যাপার ছিলনা। ( ২ ) ঐতিহাসিক ডি . ডি . কোশাম্বীও রােমিলা থাপার বিশাল প্রশাসনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য অর্থনৈতিক সংকটকে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করেছেন। ( ৩ ) ডি . আর . ভান্ডারকর মনে করেন অশােকের অনুসৃত নৈতিক ভাববাদী রাষ্ট্রনীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। এইসব দোষত্রুটি সত্ত্বেও মৌর্য শাসনব্যবস্থা সুসংহত কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় শাসনের যে নজির। গড়ে তােলে, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার এক অতি উজ্জ্বল দিক – নির্দেশ করে।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন : চন্দ্রগুপ্তের প্রচেষ্টায় বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল এবং অশােকের নেতৃত্বে এক কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু অশােকের মৃত্যুর মাত্র পাশ বৎসরের মধ্যে তার পতন ঘটে। পুরাণ ও অন্যান্য তথ্য থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ। বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে তাঁকেই হত্যা করে নিজেই মৌর্য সিংহাসন দখল করেন, এবং শুঙ্গ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল কয়েকটি কারণ,,যেমন :

প্রথমত : পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে অশােকের প্রতি ব্রাত্মণ সম্প্রদায়ের বিরােধীতা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল।

দ্বিতীয়ত : ঐতিহাসিক ভাণ্ডারকরের মতে, অশােকের অতি আধ্যাত্মিক নীতিই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে।

তৃতীয়ত : মৌর্য সাম্রাজ্যের বিশালতা সামরিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অপর অন্যতম কারণ।

চতুর্থত, অনেকে অশােকের অহিংসা নীতিকে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেছেন, কিন্তু এই অভিযােগ অমূলক। অশােক কোনও বিশেষ শ্রেণির বিরুদ্ধে তার অহিংসা ও প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধকরণ নীতি আরােপ করেননি।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্য কারণগুলাে হল :

( ১ ) অশােকের পরবর্তী মৌর্য সম্রাটদের দুর্বলতা,

( ২ ) মৌর্য সাম্রাজ্যের বিশালতা,

( ৩ ) প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অত্যাচার,

( ৪ ) মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবনতি ও রাজকোষাগারে চরম অর্থাভাব, প্রভৃতি। এ মৌর্যোত্তরকালে ভারতে বিভিন্ন রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা

[ ১ ] মৌর্য পরবর্তী যুগে ভারতে বিদেশি আক্রমণ : মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষের দিকে মৌর্য সাম্রাজ্যের দুর্বলতায় ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলতার সুযােগে একাধিক বৈদেশিক জাতি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে । এদের মধ্যে গ্রিক, শক, পহ্লাব এবং কুষাণরা ছিল উল্লেখযােগ্য। তবে এদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তারাই উত্তর-পশ্চিম ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তােলে।

[ ২ ] আঞ্চলিক রাজ্যের উৎপত্তি : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব হয়। এই সমস্ত আঞ্চলিক রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিল উত্তর ভারতের কুষাণ সাম্রাজ্য ও দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্য ।অশোকের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছর দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ,  শতধনবান ও বৃহদ্রথ এই ছয় জন সম্রাটের রাজত্বকালে মৌর্য্য সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ নিজ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হওয়ার পর, মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন এবং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে।

❏ আরও পডুনঃ মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস