প্রবন্ধ রচনা- মাতৃভাষায় শিক্ষাদান | Teaching in Mother Tongue Essay Writing

প্রবন্ধ রচনা- মাতৃভাষায় শিক্ষাদান | Teaching in Mother Tongue Essay Writing

মাতৃভাষায় শিক্ষাদান | Teaching in Mother Tongue Essay Writing

[প্রবন্ধ – সংকেত:: ভূমিকা | ভারতে ইংরাজী | পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি | উদাহরণ | উপসংহার]

ভূমিকা:- মাতৃভাযাই মনোভাব প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম, তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন — ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই হল মাতৃদুগ্ধ। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় শিক্ষালাভ যথার্থ বিকশিত হতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করলে দেশ বা জাতির শিক্ষা তথা চেতনা যথার্থভাবে বিকশিত হতে পারে; কারণ, যে ভাষাতে শিশু কথা বলা শিখে জগৎকে বুঝতে শিখেছে — জানতে পেরেছে তার জীবনকে, তার পক্ষে অন্য ভাষায় শিক্ষালাভ কি এতোই সহজসাধ্য?

তাই তো কবি গেয়েছেন— “নানান দেশের নানান ভাষা বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা” দৈনিন্দন জীবনে মানুষের প্রত্যেক মুহূর্তে যেমন কথাবার্তা মাতৃভাষাতে সম্পন্ন হয়, তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান এরই মাধ্যমে পরিণতি লাভ করে। মাতৃভাষায় অনুশীলন ছাড়া শিল্পের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হয় না। যেমন, সুদূর ইউরোপের মাতৃভাষা ছিল ল্যাটিন। এই ভাষাতেই ছিল তাদের আধিপত্য।

কালক্রমে ল্যাটিনের বন্ধন মুক্ত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন আপন মাতৃভাষায় সাহিত্য ও বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন হল, তখন থেকে সেখানকার জাতির অবরুদ্ধ প্রায় সংস্কৃতির নবজাগরণ হল এবং দেখা দিল সর্বাঙ্গীণ উন্নতি। ইংল্যান্ড Norman French ভাষা ত্যাগ করে মাতৃভাষা স্যাকসানকে অবলম্বন করতেই সেখানে জাতীয় জীবনে সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্লাবনের ধারা বইতে লাগল।

ভারতে ইংরাজী:- ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন ইংরেজরা এদেশে রাজত্ব শুরু করার পর থেকে তারা এদেশের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক মত বলার ও বোঝার সুবিধার্থে ইংরাজী শিক্ষা চালু করেন। শোনা যায় কলকাতায় প্রথম ইংরাজী পড়া ও লেখার প্রচলন হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ীতে। রাজা রামমোহন রায় বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ সাধনের প্রয়োজনে ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

তারপর থেকে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত মনীষীদের প্রচেষ্টায় ইংরাজী শিক্ষার প্রচলন বিস্তার হতে থাকে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ডেভিড হেয়ার। দীর্ঘকাল ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের পর অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ প্রভৃতি প্রত্যেকটি স্থানের কাজকর্ম ইংরাজীর মাধ্যমে চলতে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলাদেশেও বাংলা ভাষার ভূমিকার গুরুত্ব নেই। এখানে উচ্চ শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ইংরাজী। পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি : মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রসঙ্গে পক্ষে ও বিপক্ষে নানা যুক্তি দেখানো হয়। অনেকের মতে অর্থনীতি, ভূ-বিদ্যা, দর্শন এবং বিজ্ঞানসমূহ বিষয়গুলি মাতৃভাষার মাধ্যমে যথার্থ শিক্ষা দেওয়া যায় না। কারণ, ঐ সমস্ত বিষয়গুলিকে শিক্ষাদান করার মত উপযুক্ত ভাষা এবং পরিভাষা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় এখনও গড়ে ওঠেনি।

অপরপক্ষে, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু মনে করেন ঐ সমস্ত বিষয়গুলির পরিভাষা যথার্থ না থাকলেও অন্যভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া যায়। বরং প্রত্যেক পড়ুয়ার ইংরাজী সমদক্ষতা না থাকার জন্য ইংরাজীতে শিক্ষাদান করে শিক্ষার সার্থকতা আসতে পারে না। উপরোক্ত যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করে বলা যায়। আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলাভাষা বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষাদানের পক্ষে হয়তো যথেষ্ট নয়, কিন্তু এই যুক্তিতে চিরদিন ইংরাজীকে আশ্রয় করে থাকতে হবে, তার কোন যথার্থ যুক্তি নেই। বাংলা ভাষা বিশ্বে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই ভাষার শব্দ সম্ভার যে কত গভীর তা পণ্ডিতগণ অভিধান অনুশীলন করে বুঝিয়েছেন। তাই সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীগণ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হলে, তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই ভাষার ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে এবং তারই সাহায্যে বাংলা ভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের উপযোগী পরিভাষা তৈরী হবে।

উদাহরণ:- চীন, জাপান, জার্মান প্রভৃতি দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় অভাবনীয় উন্নতি সম্ভব হয়েছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ।

উপসংহার:- পশ্চিমবঙ্গে, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে ছাত্র-ছাত্রীর তথা জাতীয় ক্ষতি ব্যাপক হচ্ছে, শিক্ষার গুণগত মান হচ্ছে নিম্নমুখী। সেজন্য বর্তমানে মাতৃভাষার শিক্ষাদান সম্পর্কে সরকারী মহলে বিশেষ চেতনা এসেছে। স্কুল কলেজে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্বকে স্বীকার করে ঐ ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থাবলী লেখা হচ্ছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলায় নিতান্তই কম। এই নিরিখে বিচার করে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হবে এবং দেশের সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাব্রতী চিন্তা নায়কদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাতৃভাষায় শিক্ষাদান সর্বতোভাবে সফল হবে।