সুপ্রিয় বন্ধুরা,
Wellcome to www.ajjkal.com চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির সেরা ঠিকানা, আজ নিয়ে এসেছি কবি জয়দেব জীবনী | Biography of Poet Jaydev in Bengali . প্রতিবছর বিভিন্ন পরীক্ষার যেমন WBP | WBTET | WBCS | SSC | TET | WBPSC | Food SI | BANK EXAM | All Jobs Exam | রাজ্য বা দেশের বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা | স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি পত্র আপনাদের বিনামূল্যে দিয়ে এসেছি। তাই www.ajjkal.com আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে কবি জয়দেব জীবনী | Biography of Poet Jaydev in Bengali।
কবি জয়দেব জীবনী | Biography of Poet Jaydev in Bengali
❏ কবি পরিচয়:-
দ্বাদশ শতকের কবি হলেন জয়দেব। বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব (বর্তমান কেঁদুলি) গ্রামে তাঁর জন্ম। কেন্দুবিল্ব নামক সাগর থেকে উদ্ভূত রোহিনী নক্ষত্রের অধিপতি চাঁদ যেন তিনি (বর্ণিতং জয়দেবকেন হরেরিদং প্রবণেন/ কেন্দুবিল্বসমুদ্রসম্ভবরোহিনীরমণেন)। সমুদ্রসম্ভব চাঁদের এই উপমাটি শচীগর্ভজাত শ্রীচৈতন্যদেব প্রসঙ্গে পরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যে অমর হয়ে আছে (শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ)। তাঁর পিতা হলেন ভোজদেব এবং মাতার নাম বামাদেবী। তাঁর পত্নীর নাম পদ্মাবতী। তাঁর একজন বন্ধু হলেন পরাশর। জয়দেব ছিলেন নদীয়ার মহারাজ লক্ষ্মণসেনের (আনুমানিক ১১৭৯-১২০৫খ্রীঃ) সভাকবি। তিনি কবিরাজরাজ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।
শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত (১২০৬ খ্রীঃ) নামক সংকলন গ্রন্থে জয়দেবের নামে ৩১টি শ্লোক উদ্ধৃত আছে, তার মধ্যে ৫টি শ্লোক গীতগোবিন্দে পাওয়া যায়। এছাড়া শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে (১৬ শতাব্দী) জয়দেবের ২টি শ্লোক বিকৃত ভাবে উদ্ধৃত আছে।
❏ কাব্যপরিচয়:-
সাধারণ দৃষ্টিতে গীতগোবিন্দ সর্গবন্ধ মহাকাব্য, কাহিনী রাধাকৃষ্ণের প্রণয়। কবি স্বয়ং তাঁর কাব্যকে 'প্রবন্ধ পদাবলী', 'মঙ্গল-উজ্জ্বলগীতি' প্রভৃতি আখ্যা দিয়েছেন। বারোটি সর্গে বিন্যস্ত সমগ্র কাব্যটি। সর্গগুলির নাম ও শ্লোক সংখ্যা যথাক্রমে-
প্রথম সর্গ – সামোদদামোদর, শ্লোকসংখ্যা – ৪৯
দ্বিতীয় সর্গ – অক্লেশকেশব, শ্লোকসংখ্যা – ২১
তৃতীয় সর্গ – মুগ্ধমধুসূদন, শ্লোকসংখ্যা – ১৬
চতুর্থ সর্গ – স্নিগ্ধমধুসূদন, শ্লোকসংখ্যা – ২৩
পঞ্চম সর্গ – সাকাঙ্খপুণ্ডরীকাক্ষ, শ্লোকসংখ্যা – ২০
ষষ্ঠ সর্গ – ধৃষ্টবৈকুন্ঠ, শ্লোকসংখ্যা – ১২
সপ্তম সর্গ – নাগরনারায়ণ, শ্লোকসংখ্যা – ৪২
অষ্টম সর্গ – বিলক্ষলক্ষ্মীপতি, শ্লোকসংখ্যা – ১১
নবম সর্গ – মুগ্ধমুকুন্দ, শ্লোকসংখ্যা – ১১
দশম সর্গ – মুগ্ধমাধব, শ্লোকসংখ্যা – ১৬
একাদশ সর্গ – সানন্দগোবিন্দ, শ্লোকসংখ্যা – ৩৪
দ্বাদশ সর্গ – সুপ্রীতিপীতাম্বর, শ্লোকসংখ্যা – ৩০
❏ গীতগোবিন্দের গান:-
গীতগোবিন্দের ১২ টি সর্গে মোট ২৪ টি রাগতাললয়াশ্রিত গান আছে।
প্রথম সর্গে ৪ টি গানের মধ্যে ১ম গানটি মালব রাগ ও রূপক তালে, ২য় গানটি গুর্জরী রাগ ও নিঃসার তালে, ৩য় গানটি বসন্ত রাগ ও যতি তালে এবং ৪র্থ গানটি রামকিরী রাগ ও যতি তালে গাইতে হয়।
দ্বিতীয় সর্গে ২টি গান আছে। ১ম গানটি গুর্জ্জরী রাগ ও যতিতালে এবং ২য় গানটি মালব-গৌড় রাগ ও একতালী রাগে গাইতে হয়।
তৃতীয় সর্গের একমাত্র গানটি গুর্জ্জরী রাগ ও যতিতালে গাইতে হয়।
চতুর্থ সর্গে ২টি গান, ১ম টি কর্নাট রাগ ও যতিতালে এবং ২য় টি দেশাখ্য রাগ ও একতালী তালে গাইতে হয়।
পঞ্চম সর্গে ২টি গান আছে। ১ম টি দেশবরারী রাগ ও রূপক তালে এবং ২য় টি গুর্জ্জরী রাগ ও একতালী তালে গাইতে হয়।
ষষ্ঠ সর্গের একমাত্র গানটি গোণ্ডকীরি রাগ ও রূপক তালে গাইতে হয়।
সপ্তম সর্গে ৪টি গান আছে। ১ম গানটি মালব রাগ ও যতি তালে, ২য় টি বসন্ত রাগ ও যতিতালে, ৩য় গানটি গুর্জ্জরী রাগ ও একতালী তালে এবং ৪র্থ গানটি দেশবরারী রাগ ও রূপক তালে গাইতে হয়।
অষ্টম সর্গে একমাত্র গানটি ভৈরবী রাগ ও যতিতালে গাইতে হয়।
নবম সর্গে একমাত্র গানটি রামকিরী রাগ ও যতি তালে গাইতে হয়।
দশম সর্গে একমাত্র গানটি দেশবরারী রাগ ও অষ্টতালে (আড়, দোজ, জ্যোতি, চন্দ্রশেখর, গঞ্জন, পঞ্চ, রূপক ও সম) গাইতে হয়।
একাদশ সর্গে ৩টি গান আছে। ১ম গানটি বসন্ত রাগ ও যতিতালে, ২য় গানটি দেশবরারী রাগ ও রূপক তালে এবং ৩য় গানটি ররারী রাগ ও রূপক তালে গাইতে হয়।
দ্বাদশ সর্গের গীত সংখ্যা দুই। ১ম টি বিভাষ রাগ ও একতালী তালে এবং ২য় টি রামকীরি রাগ ও যতিতালে গাইতে হয়।
সুতরাং কাব্যটিতে সর্বসাকুল্যে গীতসংখ্যা ৪+ ২+১+২+২+১+৪+১+১+১+৩+২=২৪। ব্যবহার্য রাগ বলতে মালব, গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, মালব-গৌড়, কর্ণাট, দেশাখ্য, দেশবরাড়ী, গোণ্ডকিরী, ভৈরবী, ররাড়ী ও বিভাষ (মোট ১২ টি)। রাগ বলতে রূপক, নিঃসার, যতি, একতালী ও অষ্টতালী (মোট ৫টি)। গীতপিছু শ্লোক সংখ্যা ৫, ৮, ৯ কিংবা ১১। তবে ৮ শ্লোকের গীতই বেশি। প্রত্যেক গানেই এক একটি শ্লোকের শেষে অর্ধেক, এক বা একাধিক পংক্তি ধুয়ো হিসাবে ফিরে ফিরে আসে।
চর্যাপদের সাড়ে ৪৬ টি গানে প্রযুক্ত ১০টি রাগের মধ্যে জয়দেব ব্যবহৃত গুর্জরী, রামকিরি, বরাড়ী (বল্লাড়ী) ও ভৈরবী রাগের নাম পাওয়া যায়। জয়দেবের দেশবরাড়ী মূলত দেশাখ ও বরাড়ী রাগের মিশ্রণে গঠিত। দেশাখ রাগ চর্যাপদে ব্যবহৃত হয়েছে।
❏ গীতগোবিন্দের ছন্দ:-
গীতগোবিন্দে জয়দেব যে-সব সংস্কৃত বৃত্তছন্দ ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে শার্দুল বিক্রীড়িত ছন্দই তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল মনে হয় কারণ ৭৭টি বৃত্তছন্দে লেখা শ্লোকের মধ্যে ৩৭টি এই ছন্দে রচিত। কিন্তু এহ বাহ্য, জয়দেবের ছন্দনৈপুণ্যের পরিচয় মাত্রাছন্দে লেখা তার ২৪টি গানেই পাওয়া যাবে, এগুলোতে নয়। সংস্কৃত ছন্দকে বিদায় দিয়ে অপভ্রংশের ছন্দকে স্বাগত জানিয়েছে গীতগোবিন্দের গানগুলো। এই রকম একটি ছন্দ পাদাকুলক বা পজ্ঝটিকা।
❏ কাব্যবিচার:-
গীতগোবিন্দের খ্যাতি ভারতের সমস্ত অঞ্চলে। বিদেশী মনীষীরাও জয়দেবকে জয়মাল্য দিতে কুষ্ঠিত হননি। স্যার উইলিয়াম জোন্স কাব্যটিকে Pastoral Drama বলেছেন। লাসেন এর মতে এটি গীতিনাট্য (Lyric Drama), ফন শ্র্যেডার এর মতে শিল্পসমৃদ্ধ যাত্রা (Refined Yatra), পিশেল ও লেবির মতে সঙ্গীত ও নাটকের মধ্যবর্তী শিল্পরূপ (Category between song and drama), পিশেল এটিকে Melodrama-ও বলতে চেয়েছেন।
উইলিয়াম জোন্স প্রথম গীতগোবিন্দ অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। সেই অনুবাদকে ভিত্তি করে F.H.Van Dalberg জার্মান ভাষায় তার অনুবাদ করেন। গ্যেটে সেই অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন।
❏ কাব্যপরিচয়:-
‘গীতগোবিন্দে’ -র উৎস নিয়ে পণ্ডিত মহলে মতভেদ আছে। অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন ভাগবতের অংশবিশেষের বিষয়বস্তুকে নিয়ে ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যটি রচিত। অনেকের মতে আবার ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’র শ্রীকৃষ্ণের জন্মখণ্ডের পঞ্চদশ অধ্যায়ের সঙ্গে গীতগোবিন্দের কাহিনীর মিল আছে। এরকমও মনে করা হয়েছে প্রাকৃত-অপভ্রংশে বা লৌকিক জীবন কথায় প্রচলিত রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা গীতগোবিন্দের অপরূপ কাব্যকাহিনীকে প্রভাবিত করেছে। অনেকে ‘কৃষ্ণকর্ণামৃতে’র কবি লীলাশুক বিল্বমঙ্গলের প্রভাব পড়তে দেখেছেন এই কাব্যের উপরে। মোট দ্বাদশ সর্গে কাব্যটি লিখিত। গ্রন্থের আরম্ভে রয়েছে মঙ্গলাচরণ ও অতি বিখ্যাত দশাবতার শ্লোক। মঙ্গলাচরণের শ্লোকটি তো বিখ্যাত হয়ে রয়েছে –
মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্ বনভুবঃ শ্যামস্তমাল দ্রুমৈ।
নক্তং ভীরুরয়ব ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।
এরপরে অপূর্ব বসন্তের বর্ণনা দিয়ে প্রথম সর্গের আরম্ভ ‘সামোদদামোদর’। সখী এসে রাধাকে জানায় কৃষ্ণ অন্য গোপীদের সঙ্গে আনন্দমত্ত। ঈর্ষাকাতরা রাধা চলে গেলেন, সেখানে লতাকুঞ্জে বিলাপ করতে লাগলেন। এর পরেই দ্বিতীয় সর্গ ‘অক্লেশকেশবঃ’। রাধা কেবল কৃষ্ণকেই চান তার কারণ কেশবই তার ক্লেশ হরণ করতে পারেন। তৃতীয় সর্গ ‘মুগ্ধমধুসূদনঃ’ । অবশেষে রাধাগত হৃদয় কৃষ্ণ সুন্দরীদের ত্যাগ করে খুঁজতে লাগলেন রাধাকে। না পেয়ে বিলাপ করতে লাগলেন –
কিং করিষ্যতি কিং বদিষ্যতি সা চিরং বিরহেন।
কিং ধনেন কিং জনেন কিং মম জীবিতেন গৃহেন।।
আমার দীর্ঘ বিরহে রাধা এখন কি করছে, কি বলছে, তার অভাবে আমার ধন, জন, জীবন গৃহে কি আর প্রয়োজন। এরপরে চতুর্থ সর্গ ‘স্নিগ্ধমধুসূদনঃ’। এখানে রাধার সখী এসে শ্রীকৃষ্ণের কাছে রাধার বিরহের বর্ণনা দেয়। জানায় রাধা কেবল হরিনাম জপরতা। এরপরে পঞ্চম সর্গ ‘সাকাঙ্ক্ষঃপুণ্ডরীকাক্ষ’। এখানেই রাধার সেই প্রসিদ্ধ অভিসারের অপরূপ বণর্না –
রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম।
ন কুরু নিতম্বিনী গমন বিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম।।
ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।।
অধীরা হয়েও রাধা গমনে অসক্তা। তাই সখী ফিরে গেল কৃষ্ণের কাছে। ষষ্ঠ সর্গ ‘ধৃষ্ঠবৈকুণ্ঠঃ’। এখানে সখীর মুখে কৃষ্ণ শুনলেন রাধার বাসকসজ্জা বণর্না। এরপর সপ্তম সর্গ ‘নাগরনারায়ণ’। বিপ্রলব্ধা রাধা প্রতীক্ষায় আছেন তবু হরি আসেননি। শঙ্কিতা রাধা ভাবছেন কৃষ্ণ বুঝি আবার চলে গেছেন অন্য নায়িকার কাছে। অষ্টম সর্গ ‘বিলক্ষ্মলক্ষ্মীপতিঃ’। রতিবঞ্চিতা খণ্ডিতা নায়িকার বিলাপ এই সর্গের মূল কাহিনী। নবম সর্গ ‘মুগ্ধ মুকুন্দঃ’। শ্রীকৃষ্ণ এসেছিল। কিন্তু কলহান্তরিতা ব্যর্থ মনোরথ নায়িকা শ্রীকৃষ্ণ চলে গেলেও নিজের মান ত্যাগের জন্য প্রস্তুত নন। দশম সর্গ ‘মুগ্ধ মাধব’। এখানে মানভঙ্গের চেষ্টা। অসামান্য এই সর্গটি জয়দেবের বাক্পটুত্বে বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে –
সত্যমেবাসি যদি সুদতি ময়ি কোপিনী
দেহি খর নয়ন শর ঘাতম্।
ঘটয় ভুজবন্ধনং জনদ রদ খণ্ডনম্
যেন বা ভবতি সুখ জাতম।।
ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনম্
ত্বমসি মম ভব জলধিরত্নম।।
এরপরেই একাদশ সর্গ ‘সানন্দ গোবিন্দঃ’। শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব বাণীতে বিচলিতা রাধা সখীদের অনুরোধে চললেন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে। দ্বাদশ সর্গ ‘সুপ্রীতপীতাম্বরঃ’। পীতাম্বর কৃষ্ণ মিলিত হলেন রাধার সঙ্গে। এখানেই কাব্যের সমাপ্তি।
❏ গোত্রবিচার:-
জয়দেব তাঁর কাব্যকে নিজে বলেছিলেন ‘গীতপ্রবন্ধ’। অবশ্য প্রতি সর্গের পুষ্পিকায় ‘মহাকাব্য’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যতত্ত্বে মহাকাব্যের যে গুণের কথা বলা আছে তার অনেকগুলোই এখানে বর্তমান। এটি অষ্টাধিক সর্গে রচিত। এর নায়ক ধীরোদাত্ত, এর অঙ্গীরস অন্যতম স্বীকৃত শৃঙ্গার। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ – এই চতুবর্গের স্থান আছে এখানে। তবু যে এটি মহাকাব্য নয় তার কারণ মহাকাব্যিক বিশালতা নেই এখানে, আছে গীতের প্রাধান্য। গ্রন্থের মধ্যেও এই গীতি সংযোজিত হয়েছে। যেমন প্রথম সর্গে ৫-১৫ নং শ্লোক মালবরাগ রূপক তালে গাইতে হয়। ১৭-২৬ নং শ্লোক গুর্জরীরাগ নিঃসার তালে গাইতে হয়। ২৭-৩৭ নং শ্লোক বসন্তরাগ ও যতি তালে গাইতে হয় ইত্যাদি। এরকম প্রায় প্রতি সর্গেই অনেকগুলি করে গীতি যুক্ত আছে। সর্বসাকুল্যে কাব্যে মোট ২৪ টি গান ১২ টি রাগ ৫ টি তাল সংযোজিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের তাত্ত্বিকরা তাই একে মহাকাব্য বলতে চাননি কোনভাবেই। লাসেনের মতে এটি ‘Lyric Drama’ বা ‘গীতিনাট্য’। ডন শ্র্যেডার এর মতে ‘Refined Yatra’ । পিসেল ও লেবির মতে এটি নাটক ও সঙ্গীতের মধ্যবর্তী শিল্পরূপ। পিসেলের মতে এটি ‘Melodrama’ –ও বটে। উইলিয়াম জোনস ‘Pastoral Drama’ বলেছেন। এ বি কীথ এতে প্রাচীন লোকযাত্রার প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন।
❏ মূল্যায়ন:-
মিলনের নিবিড় আনন্দ, বিরহের অন্তদীর্ণ ব্যাকুলতা, সৌন্দর্যের মুগ্ধ আবেদন, গীতিপ্রাণতার আকাশমেশা সুর এক আধারে ধরা দিয়েছে জয়দেবের কাব্যে। বাঙালী প্রতিভার মৌলিকতার এক অনন্য নিদর্শন এ কাব্য। বাংলা ভাষা হাতের কাছে পাননি তিনি। কিন্তু সেই মেঘমেদুর আকাশতলে, তমঃশ্যামল বনভূমিতে, বর্ষাবিধূর অন্ধকারে এক দৃশ্যাতীত প্রেরনার সংকেত কবিকে পরিচিতের গণ্ডী অতিক্রম করে অপরিচিতের রহস্যমধুর অভিসারে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। বাংলা ভাষার সূর্যোদয় তখন আসন্ন। গীতগোবিন্দে সেই আবির্ভাবের অরুণোচ্ছটা দিঙ্মণ্ডলে আভাসিত। কৃষ্ণকীর্তনের পদ ঝংকারে যার বীজাকারে প্রকাশ, তার উদ্গম চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতিতে, তার পল্লব মর্মর চৈতন্যের প্রেমধর্মস্নাত জীবনে। সুতরাং জয়দেব থেকে যে বাঙালীর মানস জন্মের আরম্ভ কৃষ্ণকীর্তন-চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-কৃত্তিবাস-চৈতন্য-প্রসাদী সুর মেখে রবীন্দ্রনাথে তার আর এক স্ফূর্তি আর এক মূর্তি। এরই মধ্যে বাঙালীর অতীত সংস্কৃতির উপলব্ধি আলোকিত হয়ে আছে, এরই মধ্যে ভবিষ্যত অগ্রগতির পথ সাময়িক উদ্ভ্রান্তির কুহেলিকা জাল থেকে মুক্ত হয়ে দিগন্ত প্রসারিত ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। কবি নিজেই বলেছন-
যদি হরিস্মরণে সরসংমনো।
যদি বিলাস কলাসু কুতূহলম্।।
মধুর কোমলকান্ত পদাবলীং।
শৃণু তথা জয়দেব সরস্বতীম।।
রামায়ণ, মহাভারত গীতা ভাগবতের মধ্যে একটি জাতীয় জীবনের যে ভাবাদর্শ অম্লান দিক্চিহ্নবাহী স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে গীতগবিন্দেও বাঙালী জাতির সেই অন্তরলোকবিহারী মহিমময় ভক্তিরসাপ্লুত এক অনশ্বর জীবন প্রবাহতার বিলাসকলাকূতূহলে, তার হরি স্মরণে সরস মানসভূমিতে ধ্রুবতারার মতো নিত্যকালের দিশারী রূপে অবিচল প্রতিষ্ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
❏ সুভাষিত রত্নকোষ/ কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়:-
কোষকাব্যের মধ্যে প্রাচীনতম সংকলন ‘সুভাষিত রত্নকোষ’ (নামান্তরে কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়)। আনুমানিক একাদশ শতকে বিদ্যাধর এই কোষকাব্য সংকলন করেন। বিদ্যাধর ছিলেন (বর্তনাম মালদহ জেলার অন্তর্গত) জগদ্দল বৌদ্ধ বিহারের আচার্য। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম কোষকাব্য সুভাষিত রত্নকোষ সম্ভবত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের উৎসাহেই সঙ্কলিত হয়। প্রথম সম্পাদক F. W. Thomas অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপির প্রথম পদ অনুযায়ী গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়। এই গ্রন্থে অশ্বঘোষ, কালিদাস, ভবভূতি, অমরু, বাণ, রাজশেখর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কবিদের রচনা ব্যতীত এমন অনেক কবির নাম পাওয়া যায়, যাঁদের বাঙালী কবিরূপে চিহ্নিত করা চলে। যেমন- গৌড় অভিনন্দন, বুদ্ধাকর গুপ্ত, ধর্মাকর, কুমুদাকর মতি, বন্দ্য তথাগত, বীর্যমিত্র, শুভঙ্কর ইত্যাদি। ‘নমো বুদ্ধায়’ বাক্যটি দিয়ে গ্রন্থের আরম্ভ এবং প্রথম তিনটি ব্রজ্যায় ‘সুগত’, ‘লোকেশ্বর’ ও ‘মঞ্জু ঘোষের’ স্তুতি সংকলিত। মহেশ্বর, হরি সূর্য প্রভৃতি হিন্দু দেবতার স্তুতি পরে স্থান লাভ করেছে। বিদ্যাধর কর্তৃক সংকলনের ২৫-৩০ বছর পরে বুদ্ধাকর ও ভীমার্জুন (এঁরাও জগদ্দল বিহারের আচার্য ছিলেন) গ্রন্থটি সংস্কার করেন।
❏ সদুক্তিকর্ণামৃত:-
বাংলার সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের মহামাণ্ডলিক শ্রীধর দাস সদুক্তিকর্ণামৃত (১২০৫ খ্রীঃ) নামক কোষকাব্য সঙ্কলন করেন। অনুমান করা হয় যে রাজা কেশব সেনের রাজত্বকালে সঙ্কলনটি সমাপ্ত হয়। শ্রীধর দাসের পিতা বটু দাস ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের প্রতিরাজ (অর্থাৎ লেখক), মহাসামন্ত এবং প্রিয়পাত্র ও অন্তরঙ্গ সুহৃদ। সমগ্র গ্রন্থটি মোট পাঁচটি প্রবাহে বিভক্ত- শৃঙ্গার প্রবাহ, চাটু প্রবাহ, অমর প্রবাহ, উপদেশ প্রবাহ, উচ্চাবচ প্রবাহ। প্রবাহগুলি বীচি বা তরঙ্গে বিভক্ত এবং প্রতি তরঙ্গে ৫টি শ্লোক অন্তর্ভুক্ত। সর্বসাকুল্যে ৪৭৬ টি ৪৮৫ জন কবির ২৩৮০ টি শ্লোক সংগৃহীত। যেমন ধোয়ীর পবনদূত থেকে ২০টি শ্লোক, গোবর্ধনের ৬টি শ্লোক, গীতগোবিন্দের ৫টি ও জয়দেবের অপরাপর ২৫টি শ্লোক (মোট ৩০টি), শরণদেবের ২১টি শ্লোক, উমাপতির একানব্বইটি শ্লোক আছে।
❏ প্রাকৃত পৈঙ্গল:-
পিঙ্গলের দ্বারা রচিত ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ গ্রন্থটি একটি ছন্দ গ্রন্থ। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীতে বারাণসীধামে এই গ্রন্থের সংকলন হয়। এটি একটি সংস্কৃত গ্রন্থ, এর বিষয়বস্তু প্রাকৃত ছন্দ। মাত্রাবৃত্ত ও বর্ণবৃত্ত – এই দুই ধরণের প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ছন্দের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে সংকলক পিঙ্গল অনেক শ্লোক উল্লেখ করেছেন। এর দৃষ্টান্তগুলি শৌরসেনী প্রাকৃতে ও অপভ্রংশে রচিত। এখানে রাধাকৃষ্ণ ও কৃষ্ণগোপীলীলা সংক্রান্ত কিছু শ্লোক থাকলেও এতে বাঙালি জীবনের ধূসর ও রুক্ষ চিত্রই বেশি স্বাভাবিক ও জীবন্ত হয়েছে। একটি পদে আছে –
অরে রে বাহিহি কাহ্ন নাব ছোড়ি ডগমগ কুগই ণ দেহি।
তুহুঁ এখণই সন্তার দেই জো চাহসি সো লেহি।।
ওহে কৃষ্ণ, নৌকা বাইছ, ডগমগ (নৌকা টলমল করা) ছাড়ো। আমাদের দুর্গতির মধ্যে ফেলো না, এখনই পার করে দিয়ে যা চাও তা নাও।
কৃষ্ণ-বিষয়ক পদে রাধারও উল্লেখ লক্ষ করা যায়। দু-একটি পদে শিবেরও উল্লেখ আছে। কিন্তু বাঙালির স্বাদু জীবনভোগের চিত্রটি অতি উপাদেয় –
ওগ্গর ভত্তা, রম্ভঅ পত্তা।
গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা।
মইলি মচ্ছা, নালিচ গচ্ছা।
দিজ্জই কন্তা, খাঅ পুণ্যবন্তা।।
ওগরা ভাত (ফ্যানসা ভাত) কলাপাতায় বেড়ে দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আছে গাওয়া ঘি, সুস্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে (পাট) শাক, রন্ধন করেছেন কান্তা স্ত্রী, পরিবেশন করছেন কান্তকে, এই খাদ্য যিনি আহার করছেন, তিনি সত্যই পুণ্যবান।
এ আয়োজন রাজসিক নয়, আবার সাত্ত্বিকও নয়, কারণ আমিষের গন্ধ আছে। সেকালের পক্ষে এ আয়োজন সামান্যই। কিন্তু কান্তার রান্না পরিবেশনে স্বামী নিজেকে পুণ্যবান মনে করছেন। এ চিত্রটি ঘরোয়া হলেও বড়োই শুচিস্নিগ্ধ।
এই শ্লোকগুলি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল বলে, এতে নব্যভারতীয় ভাষার অল্পস্বল্প প্রভাব ফুতে উঠেছে। অবশ্য এ সংকলন বাংলাদেশে প্রস্তুত হয়নি, এবং সংকলকও যে বাঙালি ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবু কোনো কোনো
শ্লোকে বাঙালি জীবনের ছায়াপাত হয়েছে বলে মধ্যযুগের বাংলা কাব্য-কবিতা প্রসঙ্গে ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলে’র উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়। কৃষ্ণের গোপীলীলা, প্রকৃতিচিত্র, প্রতিদিনের জীবনের সুখ-দুঃখ বাঙালির জীবনচর্যাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:- 1000 জেনারেল নলেজ প্রশ্ন উত্তর PDF